কেন আমরা অঞ্জন দত্তর গান শুনি

30
কেন আমরা অঞ্জন দত্তর গান শুনি

‘এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না’—আজ অঞ্জন দত্ত গান গাইবেন। ঢাকার ‘আলোকি’তে আজ গিটারে মাতোয়ারা করে দেবেন দত্তবাবু। তাঁর কনসার্টের টিকিটের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে হাহাকার, এর মধ্যে কেউ তা করায়ত্ত করতে পেরেছেন, কেউবা পাননি। সব ডিঙিয়ে প্রায় ৭০ বছর বয়স্ক অঞ্জন দত্ত গানে গানে হয়তো বলবেন, ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না।’

তিনি কি সত্যিই আর আসবেন না? প্রশ্নটি কারও কারও মাথায় আঁচড় কাটছে বৈকি! কারও কারও এমনও মনে হতে পারে, আসবেন তো তিনি বটেই। কেননা, গেল কয়েক বছরে বারবারই বাংলাদেশে এসেছেন এই শিল্পী। এমনকি দিন কয়েক আগে নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছিলেন, বাংলাদেশে গিয়ে তিনি গান করতে চান।

Pop Ads

আজ ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে গাইবেন অঞ্জন দত্ত; এবং আমরা অধীর হয়ে আছি তাঁর গান শোনার জন্য। কিন্তু কেন অঞ্জন দত্তর গান শুনতে চাই আমরা? অঞ্জন যখন গাইতে থাকেন, ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে/ থাকবে না সাথে কোনো ছাতা/ শুধু দেখা হয়ে যাবে মাঝ রাস্তায়/ ভিজে যাবে চটি, জামা, মাথা/ থাকবে না রাস্তায় গাড়িঘোড়া/ দোকানপাট সব বন্ধ/ শুধু তোমার আমার হৃদয়ে/ ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ…’—হাজারবার শোনা এই গান আবার কেন শুনতে চাই আমরা, তা কি শুধু এই কারণে যে এই গান, অঞ্জনের এই সব গান কোথাও না কোথাও আমাদের নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়? গানে গানে অঞ্জন যে স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার গল্প বলেন, ছেলেটা যে স্কুলের ওই গেটে এসে হাঁপায়, তার বুক পকেটে থাকে প্রথম প্রেমের বানান ভুলওয়ালা চিঠি—এসব তো আমাদেরও জীবনের কথা! জীবনে আমরাও কতবার কত কত স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থেকেছি, এরপর খাতার ভেতরে চ্যাপটা হয়েছে গোলাপ ফুল…। না, সেই সময়গুলো হয়তো কখনোই আর ফিরে আসবে না। তবে এই গানগুলো শুনতে শুনতে অবচেতনে আমরা কি সেই সময়ে ফিরতে চাই?

যে অঞ্জন দত্ত অভিনয়শিল্পী হতে চেয়েছিলেন, যে অঞ্জন দত্তের থিয়েটার–শিক্ষার হাতেখড়ি হয় কলকাতার প্রবাদপ্রতিম নাট্যশিক্ষক বাদল সরকারের হাতে, চলচ্চিত্রে যে অঞ্জন দত্তের অভিষেক হয় কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেনের মাধ্যমে, সেই অঞ্জন দত্তকে গায়ক হিসেবে আমরা ‘আবিষ্কার’ করলাম, গত শতকের শেষার্ধে, ১৯৯৫–’৯৬ সালে। ঠিক ওই সময়, যে সময়ে নিজের জীবন নিয়ে টালমাটাল যুদ্ধে লিপ্ত অঞ্জন, তখন কি আমাদের মতো তিনিও নিজেকে আবিষ্কার করেননি গায়ক হিসেবে?

কনসার্টে অঞ্জন দত্ত
তাঁর জীবনীভিত্তিক বই ‘অঞ্জনযাত্রা’তে এ বিষয়ে অঞ্জন যা বাতলেছেন, তার মোদ্দাকথা অনেকটা এমন, সুমন (সেই সময়ের সুমন চট্টপাধ্যায়, অধুনা কবীর সুমন) যখন গিটার বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করলেন, তখন আমিও সাহস পেলাম, মনে হলো, এভাবে গিটার বাজিয়ে আমিও তো গান গাইতে পারি।

গাইতে শুরু করলেন তিনি। যেন এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। আর আমরা পেলাম নতুন এক কণ্ঠ, নতুন ধরনের গান, যে গান আমাদেরও জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে অনুভূতিকে নাড়াঘাটা করে যায়! তখন সেই নব্বই দশকের শেষাশেষি বা নতুন সহস্রাব্দের শুরুর কালে আমাদের যে জীবন, নিশ্চয় সে জীবন কলকাতার ‘ধর্মতলার মোড়ে’র জীবন ছিল না, আমরা হয়তো তখন বসে ছিলাম ঝিনাইদহের সুইট মোড়ে বা ফরিদপুরের আলীপুরে অথবা চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় কিংবা পাবনার কলেজ গেটে, কিন্তু কীভাবে কীভাবে যে কলকাতার ধর্মতলার মোড়ের জীবন আমাদের জীবনের সঙ্গেও মিলে গিয়েছিল! তাই অঞ্জনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরা গেয়েছিলাম, ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, বেলা শুনছ’।

যে অঞ্জন দত্ত অভিনয়শিল্পী হতে চেয়েছিলেন, যে অঞ্জন দত্তের থিয়েটার-শিক্ষার হাতেখড়ি হয় কলকাতার প্রবাদপ্রতিম নাট্যশিক্ষক বাদল সরকারের হাতে, চলচ্চিত্রে যে অঞ্জন দত্তের অভিষেক হয় কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেনের মাধ্যমে, সেই অঞ্জন দত্তকে গায়ক হিসেবে আমরা ‘আবিষ্কার’ করলাম, গত শতকের শেষার্ধে, ১৯৯৫-’৯৬ সালে। ঠিক ওই সময়, যে সময়ে নিজের জীবন নিয়ে টালমাটাল যুদ্ধে লিপ্ত অঞ্জন, তখন কি আমাদের মতো তিনিও নিজেকে আবিষ্কার করেননি গায়ক হিসেবে?
বাঙালি মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন দিনযাপন, প্রেম, বিরহ আর স্মৃতিকাতরতা কাহিনির মোড়কে গানের পর গানে বলে গেছেন অঞ্জন দত্ত। বলা ভালো, কবীর সুমনের হাতে আধুনিক বাংলা গানের যে নতুনতর সূচনা, সেই সূচনায় একটি ভূমিকা অঞ্জন দত্তরও আছে। আর তাঁর গানগুলোর একটি বড় বৈশিষ্ট্য এই যে এসব গানের মধ্যে কেবল মানবিক অনুভূতি নয়, বরং তার চেয়ে বেশি যা থাকে তা হলো কাহিনি। অঞ্জন তাঁর গানের মধ্য দিয়ে গল্প বলতে ভালোবাসেন। আর গানে গানে এই গল্প বলার চল আমাদের বাংলা গানেরই এক পুরোনো বৈশিষ্ট্য। আমরা যদি ‘রামায়ণের গান’ বা ‘বেহুলার গান’–এর দিকে তাকাই, দেখতে পাব, এই গানগুলোর মধ্য দিয়ে আদতে কাহিনিই বিবৃত করা হয়েছে। অঞ্জন দত্তর গানেও কাহিনির সেই সৌরভ বিদ্যমান। বিষয়টি এবার উদহারণ দিয়ে খোলাসা করা যাক। অঞ্জনের ‘চ্যাপটা গোলাপ ফুল’ গানের মধ্যে আমরা কী দেখি?

অঞ্জন দত্ত
একজন স্কুলবালিকার জন্য আরেক স্কুলবালকের আকুলতা। স্কুলের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটি, মেয়েটিকে একনজর দেখার জন্য। এই পুরো গানের মধ্যে একটি আস্ত কাহিনি আছে। আর কাহিনির মধ্যে যে আদি, মধ্য ও অন্ত থাকে, সেটিও এই গানে অক্ষুণ্ন রয়েছে। কেবল এই গানেই নয়, অঞ্জনের প্রায় সব গানেই আছে কাহিনিজাত এই আদি, মধ্য আর অন্ত। ফলে ‘চ্যাপটা গোলাপ ফুল’ গানের শেষ পর্যায়ে এসে দেখা যায় অঞ্জন বলছেন, ‘শুধু একটিবারের জন্য একটু দেখা/ ছুটি হয়ে গেলে দুজনের ইশকুল,/ নেই যে তাদের আর কোনো চাওয়া–পাওয়া/ শুধু খাতার ভেতর চ্যাপটা গোলাপ ফুল।/ আরও কত ছেলে-মেয়ের বয়স বেড়ে যাবে/ আরও কত দিনের অবসান,/ আমার ছেলেমানুষি মন আঁকড়ে ধরে রেখে/ আরও একটা ভালোবাসার গান।।’

ভালোবাসা যে এমন অনিঃশেষ ব্যাপার, অঞ্জন তা আমাদের কাহিনির ছদ্মাবরণে গানে গানে জানান দিয়ে যান; এবং আমাদের বয়স বেড়ে গেলেও ফেলে আসা স্মৃতির তো আর বয়স বাড়ে না। তাই অঞ্জন দত্তর গান যেমন আমাদের স্মৃতিতে হানা দেয়, তেমনি এসব গানের মধ্য দিয়ে বর্তমানে বাস করেও আমরা নিজেদের অতীতে ফিরে যেতে পারি। ঠিক যেভাবে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে স্মৃতিভরাতুর করে তোলে, এ অনেকটা তেমন ব্যাপার।

আদতে শিল্পীদের গানের মধ্যে তো শুধু কথা আর সুরই থাকে না, একই সঙ্গে এতে জমা হয় গানটি যখন প্রথম শুনেছিলাম, সেই সময়ের স্মৃতিও। গানের সুর আমাদের আপ্লুত করে এবং স্মৃতি আমাদের হাসায়, কাঁদায়—সোজা কথা আবেগপ্রবণ করে তোলে। প্রাকৃতিক নিয়মে হয়তো আমাদের বয়স বেড়ে যায়, পরিণত হই আমরা, অনেক বেশি বাস্তববাদী হয়ে উঠি, তারপরও প্রথম তারুণ্যের স্মৃতিগুলো, সেই মোহমাখা দিনগুলো, নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়া গল্পগুলোই হয়তো চেতন–অবচেতনে আমাদের ডাকে। শেষে তাই আবার অঞ্জন দত্তর গানটির সূত্র ধরেই বলতে পারি—যখন আরও কত ছেলেমেয়ের বয়স বেড়ে যায়, তখন তো তারা নিজেদের স্মৃতির খেয়ায়, তাদের ফেলে আসা জীবনে ফেরার বাঞ্ছা করতেই পারে, তা–ই না?