আমাদের হট্টিটি পাখিরা

40
আমাদের হট্টিটি পাখিরা

লম্বা পা–ওয়ালা মাঠে বিচরণকারী পাখি অর্থাৎ হট্টিটিদের নিয়ে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে বহু কল্পকাহিনি ছড়িয়ে আছে, যা থেকে নানা উপকথার (মিথ) জন্ম হয়েছে। হট্টিটির লম্বা পা নিয়ে একটি জনপ্রিয় উপকথা এ রকম, ‘সৃষ্টির শুরুতে গাঙটিটি (হট্টিটি) পাখির গর্ব ছিল যে সে স্বর্গ, আকাশ আর পৃথিবীর ভার বহন করতে পারে। আর এই গর্বের কথা সে প্রতিটি পাখির কাছে সর্বদা বলে বেড়াত। পাখিরা তাই শুনে শুনে তার ওপর বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল।

শেষে একদিন আর সহ্য করতে না পেরে সবাই মিলে বিধাতার কাছে গেল—এই গর্বের বিহিত করতে হবে। বিধাতা পাখিদের মুখে সব শুনে অভিশাপ দিলেন, “বংশবৃদ্ধির জন্য তাকে আকাশ বহন করতে হবে, ডিমে তা দেওয়ার সময় তাকে আকাশের দিকে দুই পা তুলে ধরে থাকতে হবে।”’

Pop Ads

এ জন্যই নাকি হট্টিটির দেহের তুলনায় পা বেশি লম্বা। আর আকাশ ভেঙে পড়ার ভয়ে হট্টিটি পা দুটি আকাশপানে তুলে শয়ন করে। বাস্তবে যদিও কখনো হট্টিটিদের আকাশের দিকে পা উঁচু করে থাকতে দেখা যায় না; তবে আঙুলের গঠনবৈশিষ্ট্যের কারণে ওরা গাছের ডালে বসতে পারে না। তাই মাটির ওপরই চলাফেরা, আহার, বিশ্রাম, প্রেম-ভালোবাসা, বংশবৃদ্ধি—সবকিছুই করে থাকে।

হট্টিটি (ল্যাপউইং) চ্যারাড্রিইডি গোত্রের সৈকত পাখি। বিশ্বে এই গোত্রের প্রজাতিসংখ্যা ৭১ ও এ দেশে ১২টি। এদের মধ্যে হট্টিটি ৬ প্রজাতির, যার ৩টি আবাসিক ও ৩টি শীতের পরিযায়ী। এদের নিয়েই আজকের গল্প।

এক. সাবাজ টিট্টি (নর্দান ল্যাপউইং): এ দেশের আবাসিক ও পরিযায়ী হট্টিটিদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে সুন্দর ও রাজকীয়। বিরল পরিযায়ী পাখিটি কালোশিরযুক্ত হট টি-টি, হাট্টিমা বা সবুজ টিট্টি (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। মূল আবাস ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ২৮-৩১ সেন্টিমিটার ও ওজন ১৪০-৩২০ গ্রাম। শীতে সিলেট বিভাগের হাওরাঞ্চলসহ কদাচ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে জোড়ায় বা ছোট দলে দেখা যায়।

দুই. গাং টিটি (রিভার/স্পার-উইংড ল্যাপউইং): এ দেশের দুর্লভ ও প্রায়-শঙ্কাগ্রস্ত আবাসিক পাখিটির অন্য নাম চরটিটি, বালুচরের টি-টি বা টিট্টিভ (পশ্চিমবঙ্গ)। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা মেলে। দেহের দৈর্ঘ্য ২৯-৩২ সেন্টিমিটার ও ওজন ১৪৩-১৮৫ গ্রাম। দেশের প্রায় সব বিভাগের বালুময় নদীতীর, খাঁড়ির বালুতট ও নুড়িসমৃদ্ধ এলাকায় একাকী, জোড়ায় বা চার থেকে ছয়টির ছোট দলে থাকে।

তিন. হলুদ-লতিকা হট্টিটি (ইয়েলো-ওয়াটল্ড ল্যাপউইং): প্রায়-শঙ্কাগ্রস্ত আবাসিক পাখিটির অন্য নাম হলদে-গাল টিটি বা হলদে টিট্টি (পশ্চিমবঙ্গ)। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ২৪-২৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ১০৮-২০৩ গ্রাম। সচরাচর ঢাকা, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে পাঁচ-সাতটির ছোট দলে বিচরণ করে।

চার. লাঙ্গইল্লা টিটি (গ্রে-হেডেড ল্যাপউইং/প্লোভার): সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখিটির অন্য নাম ধূসরমাথা হট টি-টি বা সালাং (পশ্চিমবঙ্গ)। শীতে রাশিয়া, চীন ও জাপান থেকে বাংলাদেশেসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আসে। এ দেশের সব হট্টিটির মধ্যে বৃহত্তম পাখিটির দৈর্ঘ্য ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার ও ওজন ২৩৬-২৯৬ গ্রাম। দেশজুড়ে ২৫০-৩০০টির বড় দলে দেখা যায়।

পাঁচ. লাল-লতিকা হট্টিটি (রেড-ওয়াটল্ড ল্যাপউইং): সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটি হট্টিটি বা বামন বাদশা নামেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৩২-৩৫ সেন্টিমিটার ও ওজন ১১০-২৩০ গ্রাম। দেশব্যাপী জোড়ায় বা চার থেকে আটটির ছোট দলে বিচরণ করে।

ছয়. শ্বেতলেজি টিটি (হোয়াইট-টেল্ড ল্যাপউইং): এ দেশের বিরল ও তথ্য অপ্রতুল ভবঘুরে পাখিটির অন্য নাম সাদা-লেজি টিটি। মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ রাশিয়ার এই পাখি শীতে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশে পরিযায়ী হয়। দেহের দৈর্ঘ্য ২৬-২৯ সেন্টিমিটার ও ওজন ৯৯-১৯৮ গ্রাম। সচরাচর উন্মুক্ত জলাভূমি, হ্রদ ও ঝিলের ধারে একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে দেখা যায়।

প্রজাতিভেদে হট্টিটি স্যাঁতসেঁতে তৃণভূমি, কৃষিজমি, বিল, হাওর, নদীর পাড়, ঝোপঝাড়পূর্ণ বা পাথুরে মাঠ, স্বাদুপানির জলাভূমি, ধানখেত, চর, চা-বাগান, বাদা ও উপকূলীয় এলাকা ইত্যাদিতে বিচরণ করে। বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ, কেঁচো, উইপোকা, শুঁয়াপোকা ও চিংড়িজাতীয় প্রাণী খায়। প্রায় সব প্রজাতি মার্চ থেকে জুনে প্রজনন করে।

নিজ আবাস এলাকার মাটিতে ফাঁকা শুকনো মাঠে কয়েকটি মাটির ঢেলা দিয়ে বাসা বানায় ও তাতে তিন-চারটি গাঢ় ছিটছোপসহ জলপাই-বাদামি রঙের ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে তা দেয়। প্রজাতিভেদে ডিম ফোটে ২৬-৩০ দিনে। ডিম থেকে ফুটেই ইঁচড়েপাকা ছানাগুলো দৌড়াদৌড়ি শুরু করে ও খাবার খুঁটে খায়। তবে মা–বাবা সব সময় নিরাপদ দূরত্বে¦থেকে ওদের পাহারা দেয় ও বিপদের আশঙ্কা থাকলে সংকেত দেয়। দেহের পালক ২৫-৩০ দিনে পুরোপুরি গজায় ও ৩০-৩৫ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় ৯ বছর।